সিএন অনলাইন ডেস্ক :::
মা হওয়া নয় মুখের কথা- দশ মাস দশ দিনের সময়টা কম নয়। সভ্যতার বিবর্তনে যতই নানা নিয়ম আলগা হোক না কেন, মা হওয়ার নিয়ম নিয়ে এখনও কড়াকড়ি।
তাই লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে পশ্চিমবঙ্গেও রমরমিয়ে চলছে সিলিকন পেট বা নকল পেটের ব্যবসা।
সারোগেসি বা গর্ভভাড়ার বিষয়টি ভারতীয় চলচ্চিত্রের তারকা আমির খান, শাহরুখ খান, করণ জোহর, তুষার কাপুর প্রমুখদের সৌজন্যে এখন আর অজানা নয়। তাঁরা প্রত্যেকেই গর্ভ ভাড়া করে সন্তান নিয়েছেন। কিন্তু তাতে সমাজে সারোগেসি এখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই এখনো রাখঢাক করে সারোগেট মায়েদের সাহায্যে মা হওয়ার বিজ্ঞানকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন নারীরা। সিলিকনের তৈরি কৃত্রিম অঙ্গের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে নকল পেট।
সমাজ নিয়ে বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের সমস্যা যেন সব সময়ই একটু বেশি। তাঁরা যে সমাজে বাস করেন, তা বহিরঙ্গে আধুনিক হলেও তার অন্দরে সংস্কারের শিকড় এখনও ছড়িয়ে। তাই জৈবিকভাবে সন্তানের মা হয়েও স্রেফ সমাজের কাছে মাতৃত্ব দেখানোর জন্য মহিলারা নকল পেটের আশ্রয় নিচ্ছেন। বাড়ির সদস্যরা হাত দিয়ে পেট ছুঁয়ে শিশুর উপস্থিতি নিয়ে যাতে সংশয় দেখাতে না পারেন, সে জন্যও রয়েছে ব্যবস্থা।
কলকাতার নাগেরবাজারের বাসিন্দা ৩৮ বছরের পৃথা সরকারের (নাম পরিবর্তিত) ১৩ বছর আগে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু, এখনও মা হতে পারেননি। ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তাঁর স্বামী সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম। তাই একজন পুরুষ দাতার শুক্রাণু নিয়ে পৃথার ডিম্বাণুকে কাজে লাগিয়ে সেই ভ্রূণ সারোগেট মায়ের শরীরে প্রতিস্থাপিত করা হয়। অর্থাৎ, সারোগেসির মাধ্যমে দশ মাস পর পৃথা মা হবেন, অথচ তাঁর বহিরঙ্গে কোনো পরিবর্তন হবে না। এটা কীভাবে সমাজ মেনে নেবে? কেন বিশ্বাস করবে সারোগেট মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুটি পৃথারই উত্তরসূরি? কেনই বা তাঁকে গর্ভধারিণী মা বলে স্বীকৃতি দেবে? এই সব প্রশ্নের সমাধান করার লক্ষ্যেই এসেছে সিলিকন বেলি বা নকল পেটের ভাবনা।
হাওড়া জেলার লিলুয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ে কাজ করছেন প্রস্থেটিস্ট সুমিত্রা আগরওয়াল। তাঁর ক্লিনিকে ক্রমশ ভিড় বেড়েই চলেছে। বহু মা তাঁর কাছে আসছেন, যারা নকল পেট লাগিয়ে পরিবার বা সমাজের কাছে অভিনয় করতে চান। সুমিত্রা বলেন, ‘সবাই দেখাতে চায় যে, আমি শিশুটিকে গর্ভে ধারণ করেছি। তাই আমাদের কাছে সিলিকন বেলি নিতে আসে। আমরা মহিলার কোমরের সাইজ অনুযায়ী নকল পেট তৈরি করে দিই। সেটিকে মহিলার পেটের ওপর লাগিয়ে দেওয়া হয়। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ক্ষেত্রে পেটের সঙ্গে কোমরও চওড়া দেখায়। সিলিকন বেলি সেইভাবেই তৈরি। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবেন না যে, পোশাকের নিচে কী আছে। ‘
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের আপনজনেরা গর্ভবতীর পেটে হাত দিয়ে তার ভেতরের শিশুটির উপস্থিতি আঁচ করতে চান। সিলিকন বেলি পরলে সেটা কি বোঝা যাবে? সুমি্ত্রার জবাব, ‘নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। যাঁদের এ ধরনের প্রয়োজন থাকে, তাঁদের আমরা নকল শিশুর ব্যবস্থাও করে দিই। নকল পেটের ভেতরে সেটাকে এমনভাবে রাখা হয় যাতে বাইরে থেকে হাত দিলে বোঝা যায়, ভেতরে বাড়তে থাকা শিশুটির অস্তিত্ব বা উপস্থিতি। সে ক্ষেত্রে নকল পেটের ওজনও বেশি হয়। ‘
নকল পেটের খরচ কেমন? সুমিত্রা জানান, ‘বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে পেটের দাম কেমন হবে। ৩, ৬ ও ৯ মাসের গর্ভাবস্থার জন্য আলাদা আলাদা আকারের সিলিকন বেলি পাওয়া যায়। সেই নকল পেট তৈরি করা হয় প্রত্যেক মহিলার আলাদা শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। কৃত্রিম শিশু জুড়লে দাম কিছুটা বাড়ে। এই দামটা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ‘
কলকাতার বিশিষ্ট প্রসূতি বিশেষজ্ঞ এবং আইভিএফ ক্লিনিকের কর্তা চিকিৎসক এস এম রহমান দীর্ঘদিন ধরেই সারোগেসির তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘অনেক মা-বাবাই আমাদের ক্লিনিকে আসেন, যাঁরা সমাজকে দেখাতে চান, তাঁরাই শিশুর জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী। আমরা তাঁদের কাউন্সেলিং করাই। আমির খান, শাহরুখ খান, তুষার কাপুরদের উদাহরণ তুলে ধরে বলি, ওঁদের তো নকল পেট নিয়ে অভিনয় করার দরকার হয়নি। তাহলে আপনারা কেন প্রস্থেটিক বেলি নিয়ে ভাবছেন?’
ডাক্তার রহমানের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে, ভারত মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর কথা ভাবতে পারে, কিন্তু সেই দেশের সমাজ সিঙ্গল মাদারের কথা চিন্তা করতে পারে না! চিকিৎসক আরো জানান, ‘আমাকে অনেক দম্পতি পাল্টা জবাব দিয়েছেন, আমির খান বা তুষার কাপুর তাঁদের মতো সাধারণ মানুষ নন। ওঁরা এসব সমালোচনার ঊর্দ্ধে। তাই আমাদের নকল পেট নিয়ে অভিনয় করা ছাড়া পথ নেই। সত্যিই কোনো ভুল নেই এই উপলব্ধিতে। ‘
সারোগেসি এখন মাতৃত্বলাভের প্রচলিত উপায়। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রচার কি এই ধরনের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারে? ডা. রহমানের মতে, ‘আমাদের দেশে জনসংখ্যা এত বেশি যে, সরকার কোনো দম্পতির সন্তানধারণ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। বরং তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে প্রচার করে। তাই সরকারি স্তরে কোনো উদ্যোগ দেখতে পাওয়া মুশকিল। ‘
মহাভারতের কুন্তী ও মাদ্রীর স্বামী রাজা পাণ্ডু সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম ছিলেন। তাই নিয়োগ প্রথায় তাঁরা পঞ্চপাণ্ডবের মা হন বলে মনে করা হয়। অথচ কাহিনীকার বেদব্যাস তাঁদের সন্তানধারণকে দুর্বাসা মুনির মন্ত্রের গুণ বলে দাবি করেছেন। এ যুগে অন্তত মন্ত্রের কথা বলে মা হওয়ার জো নেই। তাই সিলিকন বেলির জয়জয়কার। সেটাই হাসি ফোটাচ্ছে আজকের পৃথাদের মুখে।
সূত্র : ডিডাব্লিউ
পাঠকের মতামত: